ভূত চতুর্দশী কী? কেন পালন করা হয় দিনটি?

ভূত চতুর্দশী কী: ভূত চতুর্দশী কথাটা শুনলে একটা বেশ রহস্যময় গা ছমছমে ভাব মনে আসে। তবে তার সাথে সাথে মনের মধ্যে চলতে থাকে উৎসবের আনন্দও। এটি বাংলায় প্রচলিত উৎসব। ভূত চতুর্দশীর এই প্রথা হিন্দু ধর্মের হলেও ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে সেরকম ভাবে এই ভূত চতুর্দশীর দিনটা পালন করা হয় না। তাই এটিকে বাংলার ঐতিহ্যের একটি অংশ বলা যায়।   

প্রত্যেক বছরে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন পালন করা হয় এই চতুর্দশী প্রথা। রীতিটি সময়ের সাথে সাথে এখনও এগিয়ে চলছে। প্রত্যেকে নিজের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি রীতি প্রচলিত আছে যা হলো চোদ্দ শাক খাওয়া। এই দিন ১৪ রকমের শাক রান্না করে খেতে হয়। যেগুলি রান্না করে খেতে হয় তার নাম তুলে ধরা হল – ওল, পুঁই, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, লাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাট পাতা ও শুষনী শাক। এই ১৪ রকমের পাতা বা শাক রান্না করে খায় এই দিন। চতুর্দশীর দিন সকলে এই চৌদ্দ শাক ভাজা দুপুর বেলা খেয়ে থাকে এবং এরপর সন্ধ্যাবেলা হলে বাড়িতে চৌদ্দটা মাটির প্রদীপ জ্বালায়। এর পরের দিনই থাকে দীপাবলি এবং একইসাথে বাংলার কালীপুজো তাই একটা জমজমাট আনন্দতে থাকে সমস্ত বাঙালিরাই। 

ভূত চতুর্দশী ও হ্যালোইন

অনেকে এই ভূত চতুর্দশীর দিনটাকে পশ্চিমের দেশগুলোতে পালিত হওয়া হ্যালোইনের সাথে তুলনা করে থাকে। হ্যালোইনে বাচ্চা থেকে বড় সবাই নানা অদ্ভুত ভৌতিক পোশাক পড়ে পার্টি করে। বাচ্চারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টফি, চকলেট সংগ্রহ করে। সবাই তাদের বাড়ি এবং এলাকাটাকে ভুতুড়ে কায়দায় সাজিয়ে তোলে। একেবারে জমজমাটি ভুতুড়ে আনন্দ। তার সঙ্গে তারা বড় বড় পাকা কুমড়ো কেটে নানা ভয়ঙ্কর মুখ চোখ বানায় এবং তার মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। এই কুমড়োর মধ্যে ভয়ঙ্কর মুখ হ্যালোইনের প্রতীক হয়েছে বলা চলে। এ রকম আরও একটি রীতি উৎসব চালু আছে মেক্সিকোতে যা ‘অল স্যোল ডে‘ নামে পরিচিত। সেখানেও মানুষ নিজেদের পূর্বপুরুষদের আত্মার সম্মান জানানোর জন্য ভূত সেজে এই অনুষ্ঠান পালন করে। তবে এই ধরনের অনুষ্ঠান গুলো গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠান।

আর অন্যদিকে সারা বাংলায় এই ভূত চতুর্দশী পালিত হলেও তা সেই ভাবে পরিচিতি পায়নি বিশ্বের দরবারে। তবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ভূত চতুর্দশীর দিন দেখা যায় অনেকেই ভূত সেজে বের হয় রাস্তায় এবং মজা করে থাকে বলা যেতে পারে। ধীরে ধীরে মানুষ হ্যালোইনের মতো আনন্দে পালন করছে ভূত চতুর্দশীর দিন। অনেকেই হ্যালোইন এবং ভূতচতুর্দশী কে একই রকম অনুষ্ঠান মনে করেন। তার কারণ হলো বছরের প্রায় একই সময়ে এই অনুষ্ঠান দুটি পালন করা হয়। আর একটি অনুষ্ঠানে প্রদীপ জ্বালানো হয়। অন্যদিকে কুমড়োর মধ্যে বাতি জালানো হয়। চতুর্দশীতে ১৪ রকমের শাক খাওয়া হয়। আবার হ্যালোইনে নানা রকমের ভালোমন্দ খেয়ে থাকে সকলে। তাই অনেকে মনে করেন পরলোক ও ইহলোকের মিলনস্থল এই দিনে পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় অনুষ্ঠান দুটির দ্বারা।

আরও পড়ুন – মহালয়া কী? মহালয়ার তর্পণ এর সূচনা রহস্য

হ্যালোইনের সাথে ভূত চতুর্দশীর মিল খুঁজে পেলেও বেশ অনেকটাই আলাদা এই ভূত চতুর্দশী। সারা বাংলা জুড়ে এই ভূত চতুর্দশী নিয়ে নানাবিধ গল্প প্রচলিত আছে। আর তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল – এক সময় দানবরাজ বলি নিজের ক্ষমতায় স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল জয় করে। তার জয়ের পর শুরু হয় নানা রকম অন্যায় অত্যাচার। বলি ছিলেন ভগবান শিবের ভক্ত। তাকে আটকাতে সকল দেবতা ভগবান বিষ্ণুর কাছে যান। ভগবান বিষ্ণু তাকে থামাতে বামন অবতার ধারণ করেন। তিনি এই অবতারে রাজা বলির কাছে তিন পা সমান জমি প্রার্থনা করেন। রাজাবলি তাকে চিনতে পেরেছিলেন। তবুও তিনি রাজি হয়ে যান। তখন বামন অবতার রূপে ভগবান বিষ্ণু স্বর্গ ও মর্ত্যে পা রাখেন এবং তার নাভি থেকে বের হয় আরেকটি পা। তখন বলি ভগবানের পা নিজের মাথায় রাখেন। রাজা বলি যেমনি ছিলেন না কেন শেষে ভগবানের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে ভগবান তাকে আশীর্বাদ দেন এবং বলেন ওইদিন মর্তে তাকে লোকে পূজা করবে। মনে করা হয় ওই দিন রাজা বলি ও তার সমস্ত ভুত-প্রেত সঙ্গীদের নিয়ে মর্তে আসেন। আর ঘোর অন্ধকার রাতে ভূতের উপদ্রব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রকৃতি থেকে জোগাড় করা ১৪ রকম শাক খেয়ে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যাওয়া আত্মাদের আত্মিক তুষ্ট করা হয়। 

ভূত চতুর্দশী কী|পঞ্চ ভূত কী

তবে এর কিছু বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যেখানে এই অনুষ্ঠানের কিছু কারণ বর্ণনা করা হয়। আর তা বেশ প্রাসঙ্গিক। ভূতচতুর্দশী বলতে আমাদের মনে আসে আত্মার কথা, পরলোকের বাসিন্দাদের কথা। যারা অতীত হয়েছে তারাই ভূত। তবে এ ভূত সে ভূত নয়। শাস্ত্র মতে আমাদের শরীর পঞ্চভূতে তৈরি আর এই পঞ্চ ভূত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। অর্থাৎ ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ এই পাঁচটি ভূতের মিলনে আমাদের দেহ তৈরি হয়। পঞ্চভূতে নির্মিত এই দেহ ও মনকে সংশোধনের জন্য এই চতুর্দশী দিনটি পালন করা হয়। যেমন কোন যন্ত্র দীর্ঘদিন চলার পর তাতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে তেমনি আমাদের দেহ একটি যন্ত্র। তাই দীর্ঘ দিন চলার ফলে তাতে নানা দুর্বলতা আসে। শুধু দেহে নয় এই ক্ষয় চিন্তাতেও আসে। শারীরিক ও মানসিক অবক্ষয়কে আটকানোর জন্য ১৪ রকম শাক একত্রে রান্না করে খাওয়ার মাধ্যমে তার পরিশোধন হয়। হিন্দু ধর্মের নানা রকম আচার অনুষ্ঠান রয়েছে যার মধ্যে এটিও একটি। শরীর, মন ও সামাজিকভাবে সুন্দর থাকার জন্য এই সমস্ত প্রথম মেনে চলা হয়। 

ভূত চতুর্দশী কেন পালন করা হয় দিনটি?

অমাবস্যার আগে চতুর্দশীর দিন এই পঞ্চভূতের পরিশোধনের অনুষ্ঠান করা হয় বলে একে ভূতচতুর্দশী বলে। আর এই দিনে আমাদের সমস্ত মানসিক দুর্বলতা জয় করার প্রতিশ্রুতির দিন। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ এর প্রতিশ্রুতি পালন করা হয় এই দিনে। যেমন অন্ধকারের মধ্যেই আলোর সৃষ্টি। তেমনি অন্ধকার রাতে চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকারকে সরিয়ে আলোকিত করে উদযাপন করা হয় দিনটা। এছাড়া শরৎকাল থেকে হেমন্তকালের ঋতু পরিবর্তনের সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই। তাই এই সময় ১৪ শাক খাওয়া জরুরি। এগুলি ওষুধের মতোই কাজ করে তাই। তাই এইভাবে বিচার করে বলাই যায় এটি শুধু আধ্যাত্বিক আনন্দ অনুষ্ঠান নয়। এটি আসলে জীবন দর্শনের একটি অংশ। 

“ভূত চতুর্দশী কী? কেন পালন করা হয় দিনটি?”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন