আমাজন অরণ্যের রহস্য, আদিবাসী, অববাহিকা, জীবজন্তু ও উদ্ভিদ

 আমাজন অরণ্যের রহস্য: পৃথিবীর সৃষ্টির পর আজ বহু সময় অতিবাহিত হয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে প্রাচীন পৃথিবীর। যে গ্রহে প্রাচীনকালে ডাইনোসরের মত প্রাণীরা ঘুরে বেড়াতো সেই গ্রহ থেকে আজকের পৃথিবীর পার্থক্য বিশাল। প্রাচীনকালে পৃথিবীর অরণ্যে ঘেরা এক আলাদা ও সৌন্দর্যের সাথে বিরাজমান ছিল। ধীরে ধীরে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে সেই অরণ্য ও প্রাণী আজ বিলুপ্তপ্রায়। এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় অরণ্য গুলির মধ্যে অ্যামাজনের জঙ্গল আজও টিকে আছে পৃথিবীতে এবং তার সঙ্গে পৃথিবীর সবথেকে বেশি প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ এই জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই জঙ্গলে প্রাণীর মধ্যে এমন অনেক প্রাণী আছে যা আজও মানুষের কাছে অজানা।   

অজানা রহস্য ভরপুর এই অ্যামাজন এর জঙ্গলের বিস্তার কল্পনাতীত। প্রায় ৭০ লাখ বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই জঙ্গল। যার মধ্যে ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আদ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। আমাজন অববাহিকার অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকায়। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে অবস্থিত এই বিশাল অরণ্য মোট ৯টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। উত্তর আমেরিকার এই ৯টি দেশ হলো – ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরু, ভেনিজুয়েলা, গুয়ানা, সুরিনাম, ইকুয়েডর, ফ্রেঞ্চ গুয়ানা এবং বলিভিয়া। এই ৯টি দেশের মধ্যে এই অরণ্যের ৬০ ভাগ রয়েছে ব্রাজিলের, ১৩ ভাগ পেরুতে এবং ২৭ ভাগ বাকি দেশগুলো জুড়ে বিস্তৃত।  

আমাজন অরণ্যের অববাহিকা

পৃথিবীতে যত অরণ্য বর্তমানে টিকে রয়েছে তার মধ্যে এই আমাজন অববাহিকার অরণ্যে একমাত্র সবথেকে বড় গাছ এবং সর্বাধিক ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানকার গাছগুলোর উচ্চতা অনেকটাই বেশি কারণ অতিরিক্ত ঘনত্বের কারণে সূর্যের কিরণ মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সূর্যালোকের প্রয়োজনে গাছগুলি মাটি থেকে অনেক উপর পর্যন্ত বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই ধীরে ধীরে এখানকার উদ্ভিদ এত উচ্চতা প্রাপ্ত লাভ করেছে। এই অরণ্যের উদ্ভিত গুলি ১২০ ফুট পর্যন্ত উচু। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই অরণ্যে। এছাড়া রয়েছে ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১,২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। বলা বাহুল্য এত প্রজাতির ভিন্নতার সঙ্গে আরও অজানা অনেক জীব অণুজীব এই অরণ্যে বিরাজমান। এত ধরনের প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ সমৃদ্ধ এই অরণ্য আশ্চর্য রহস্যে ঘেরা। পৃথিবী প্রাণকেন্দ্র এই অরণ্য তার যথাযথ কারণ হল পৃথিবীতে প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আসে এই আমাজন অরণ্য থেকেই।   

আরও পড়ুন : অস্ট্রেলিয়ার 10 টি ঐতিহ্যবাহী স্থান, heritage places in Australia in bengali  

অ্যামাজনের অরণ্য অ্যামাজন নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় অরণ্য। ৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ৩.৪ মিলিয়ন বর্গ মাইল আয়তন বিশিষ্ট এই অরণ্য দক্ষিণ আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত ৯টি দেশের মধ্যে বিস্তৃত। যে দেশগুলির কথা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এর আয়তন এত বৃহৎ হওয়ার কারণে দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশ অরণ্যের দখলে। এর অপরূপ ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য যদি পর্যবেক্ষণ করতে হয় তবে দক্ষ গাইড এবং নদীপথই একমাত্র উপায়।  

আমাজন অরণ্যের আদিবাসী

আমাজন অববাহিকার জঙ্গল রেইনফরেস্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে রেইনফরেস্ট বলার কারণ এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত নয়। এই জঙ্গলে অতিরিক্ত মাত্রায় আদ্রতা, গরম আবহাওয়া, বৃষ্টির কারণে এটির এমন নাম। মাত্রাতিরিক্ত বড় বড় গাছের কারণে সূর্যালোক মাটিতে পৌঁছায় না, এরই সঙ্গে বাতাস চলাচলেও বাধা পায়। বাতাস চলাচল করতে না পারার কারণে গরম বাতাস এখানে বদ্ধ হয়ে গরম আবহাওয়া সৃষ্টি করে। প্রচণ্ড গরমে বাষ্পীভবনের হারও এখানে বেশি হয়। যে কারণে এই অঞ্চলের আদ্রতার পরিমাণ এত অধিক। বৃষ্টিপাত ও অতিরিক্ত আদ্রতার কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্রের ভরপুর এই অরণ্য পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকে হাজার হাজার বছর ধরে এখানে জীবন টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। এর চেয়ে অবাক করা তথ্য হলো এই জঙ্গলে আজও আদিবাসীদের বাস। যারা আমাদের আধুনিক জগতের চেয়ে বহু দূরে। সেখানে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া পড়েনি। বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী আজও আমাজনের গভীর জঙ্গলে ৫০টি গোত্রের প্রায় ২১ মিলিয়ন মানুষ বাস করে।   

অ্যামাজন এর জঙ্গলের বিস্তার এত বেশি তার কারণ এর মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া অ্যামাজন নদী। এই নদীই মূল অববাহিকার প্রাণকেন্দ্র। আমাজন নদী পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নদী। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু দেশের আন্দিজ পর্বতমালার নেভাদো মিসমি পাহাড় চুরা থেকে সৃষ্টি এই বৃহদ নদীর। দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি দেশের উপর দিয়ে প্রায় ৬৪০০ কিলোমিটার (৩০০০ মাইল) পথ অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে। এটির প্রস্থ জায়গা বিশেষ ১০ কিলোমিটার, তবে বন্যায় এটির প্রস্থ ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।  

আমাজন অরণ্যের জীবজন্তু ও উদ্ভিদ

এই গ্রহে যতগুলি নদী বর্তমান তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জল ধারণ ক্ষমতা আমাজন নদীর। এই নদী যখন আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয় তখন সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘনফুট জল দিয়ে পড়ে। বিশেষ করে বর্ষাকালে এটির পরিমাণ দুগুন হয়। আমাজন নদীতে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বাস করে। এর মধ্যে রয়েছে ৪ মিটারেরও বেশি লম্বা ফ্রেশ ওয়াটার ফিস, ক্যাটফিশ, বুল সার্ক, ইলেকট্রিক ইল এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মাছ পিরানহা। আমাজন নদীতেই পৃথিবীর মোট মাছের সংখ্যার ২০ শতাংশ মাছ পাওয়া যায় যা সত্যি আশ্চর্যের।   

এত বৃহৎ এবং রহস্য ও আশ্চর্যে ভরপুর এই অ্যামাজন অববাহিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারনারও অভাব নেই। অ্যামাজনের বসবাসকারী আদিবাসী এবং পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা মনে করতেন অ্যামাজন এর জঙ্গলের মাঝে কোথাও একটা লুকিয়ে আছে অজানা এক শহর। আমাজনের গভীরে গ্রীক পুরাণ মতে এক সম্পূর্ণ সোনা দ্বারা নির্মিত শহরের অবস্থান, যার নাম এলডোরাডো। এই শহরটি পাহারা দেয় নারী যোদ্ধারা যারা আমাজন নামে পরিচিত। সোনায় ঘেরা এই শহরের খোঁজে পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা এটি খোঁজার জন্যে অভিযান চালান। কিন্তুু হতে আসে কেবল নিরাশা। তবে কথিত আছে এই নারী যোদ্ধাদের নামেই নামাঙ্কিত হয়েছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অববাহিকা আমাজনের। 

Leave a Reply