পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। Lighthouse of Alexandria in bengali

পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, Lighthouse of Alexandria in bengali: আজকের এই নিবন্ধটি আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, বাতিঘর কি, আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এর নির্মাণ ইতিহাস, আলেকজান্দ্রিয়া শহর সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

বাতিঘর কি? বাতিঘর শব্দের অর্থ কি:

বাতিঘর বা লাইট হাউস হল এমন এক মানুষ দ্বারা নির্মিত ঘর যেটি সমুদ্রে যাতায়াতকারী জাহাজ গুলিকে ও ছোটছোট নৌকাগুলোকে পথ দেখায়। রাতের অন্ধকারে সমুদ্রে চলাচল কারী নৌকা ও বড় বড় জাহাজ গুলো যাতে তাদের নির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হতে পারে সে কারণে বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। কেবলমাত্র নাবিকদের দিক নির্ধারন- ই নয়, বাতিঘর গুলি সমুদ্র সৈকতের অগভীর এলাকা গুলি চিহ্নিতকরণের সাথে সাথে যেসব এলাকায় প্রচুর প্রবল প্রাচীর আছে সেগুলি থেকেও সতর্কীকরণের কাজ করে থাকে এই বাতিঘর গুলি।

বর্তমান বিশ্ব পূর্বের তুলনায় অনেক আধুনিক। আবিষ্কারকদের আবিষ্কৃত নিত্য নতুন যন্ত্রপাতি ও আধুনিক প্রযুক্তির ফলে বর্তমানে বাতিঘরের ব্যবহার কমে গেছে। তবে পূর্বে আধুনিক প্রযুক্তির অভাবের কারণে নাবিকদের দিক নির্ধারণ ও জাহাজকে অগভীর জলে নিয়ে যাওয়ার মতো বড় বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে বাতিঘর গুলির প্রয়োজনীয়তা অধিক ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে কালের নিয়মে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের যেমন ভূমিকম্প, সুনামির মতো কারণে সমুদ্র সৈকতের নির্মিত বেশিরভাগ বাতিঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রাচীনকালে অর্থাৎ লাইটহাউস বা বাতিঘর নির্মাণের কল্পনাও যে সময় মানুষ করেনি সে সময় মানুষ আগুনের ব্যবহার করতো। অগভীর সমুদ্র সৈকত ও যে সমস্ত সৈকত প্রবাল প্রাচীর দ্বারা নির্মিত সেই সমুদ্রসৈকতে যাতে কোন জাহাজ এসে না পড়ে, সে কারণে পূর্বে মানুষরা সৈকত নিকটবর্তী উঁচু পাহাড়ের উপরে আগুনের কুন্ডলী প্রদর্শন করত। যার ফলে জাহাজ ভেঙে যাওয়ার মত বড় কোনো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে জাহাজ ও জাহাজের যাত্রীরা।

আরও পড়ুন- কাল মার্কস এর জীবনী। কিভাবে তৈরি হলো কমিউনিস্ট লীগ?

এরপর ধীরে ধীরে এই আগুনের প্রদর্শন ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকে। এরপর একটা সময় বড় বড় কাঠের আগুন জ্বালিয়ে সমুদ্রের দূর-দূরান্তে থাকা নাবিকদের অগভীর সমুদ্র, সমুদ্রের নিচে থাকা প্রবাল প্রাচীর এবং দিক নির্ণয়ের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়া হতো। এরপর ধীরে ধীরে নির্মাণ হতে থাকে স্থায়ী জায়গা, যেখানে থেকে আগুন জ্বালিয়ে সতর্কবার্তা পাঠানো হতো। এই ভাবে সময়ের সাথে সাথে গড়ে ওঠে আধুনিক বাতিঘর বা লাইটহাউস গুলি।

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত অনেক বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেই সমস্ত বাতিঘর গুলির মধ্যে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক বাতিঘর টলেমিয় রাজবংশের শাসন কালে নির্মিত বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর টি। এছাড়া রয়েছ টরিসিলির বাতিঘর। যেটি নির্মাণ হয়েছিল ১৮৮৭ সালে( মতান্তরে ১৮৯৭)। 

আলেকজান্দ্রিয়া কি:

আলেকজান্দ্রিয়া (আরবি ভাষায় আল ইস্কান্দারিয়া) শহরটি মিশরে অবস্থিত শহর গুলির মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন মিশরের সবচেয়ে বড় সমুদ্র বন্দরটি এই আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অবস্থিত। এই শহরটি মিশরের উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের ধারে প্রায় ৩২ কিলোমিটার অর্থাৎ ২০ মাইল জায়গা জুড়ে বিস্তীর্ণ। মিশরের বাণিজ্য ও শিল্প কেন্দ্রের একমাত্র কেন্দ্র বিন্দু এই আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি। সুয়েজ খাল থেকে আসা তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস এই বন্দরের পাইপলাইন হয়েই প্রবেশ করে মিশরে। মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া শহরকে মহাফজা বলা হয়। কারণ শহরটি গভর্ণর শাসিত শহর। পূর্বে মহান আলেকজান্ডার এই শহরের নির্মাণ করেন যে কারণে শহরটির নাম তার নামে নামাঙ্কিত।

সম্প্রতি আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া সামুদ্রিক নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে জানা গেছে আলেকজান্ডার এই শহরে আগমনের পূর্বে এই শহরটির নাম ছিল রাকোটিস। 

দ্যা গ্রেট আলেকজান্ডার এর নামানুসারে মিশরের রাকোটিস শহরটির নাম আলেকজান্দ্রিয়া হওয়ার কিছু পরে সেখানে টলেমিয় রাজবংশের রাজত্বকালে সূচনা ঘটে। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর সম্পর্কে যারা গবেষণা করেছেন তাদের অধিকাংশ গবেষকদের ধারণা এই রাজবংশের রাজত্বকালে ভিতরে নির্মাণ করা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরটি। 

আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এর নির্মাণ ইতিহাস:

টলেমিয় রাজবংশের সময়ে প্রায় ৩৩ বছর ধরে নির্মাণ করা বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরটি। রাজবংশের সময়কালে ২৮০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ২৪৭ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত নির্মাণকার্য চলে আলেকজান্দ্রি়ায় বাতিঘরের। বৃহৎ এই বাতিঘরটি ভিত্তিভূমির আয়তন ছিল ১১০ বর্গফুট। আয়তনে বড় হওয়ার সাথে সাথে এর উচ্চতাও ছিলো অধিক। আলেকজান্দ্রিয় বাতিঘরটির উচ্চতার সম্পূর্ণ নির্মাণের পর ৪৫০ ফুটে গিয়ে দাঁড়ায়। এত উঁচু ও বৃহৎ বাতিঘরটি মূল চূড়ায় অর্থাৎ যেখানে বাতি জালানো হতো সেখানে পৌছানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল সিড়ির। মূলত বাতি ঘরের ভিতরের অংশ গোটা শরীরে একটাই পেঁচানো সিঁড়ির নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি ব্যবহার করে বাতিঘর এর উপরে আগুন জ্বালিয়ে জাহাজের নাবিকদের সতর্কবার্তা দেওয়া হতো। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর এতটাই বৃহৎ ছিল যে খোলা সমুদ্রে ৫০ মাইল দূর থেকেও বাতিঘরটি দেখতে পাওয়া যেত।

১২০ থেকে ১৩০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর নির্মাণ এর পরে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চ বাতিঘর হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এর পরবর্তী ৯৫৬ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্পে প্রচন্ড পরিমানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে এটি। এতবার ভূমিকম্পের শিকার হওয়ার পর শেষে ১৪’ শ শতকে প্রবল ভূমিকম্পে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এর অবশেষ আজও সমুদ্রের তলায় পাওয়া যায়, যা থেকে বিভিন্ন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসে এটি সম্পর্কে। প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য নিদর্শন ছিল এই বাতিঘরটি। এত বছর পূর্বে এত বৃহৎ নির্মাণ মানুষকে আজও ভাবতে ও আশ্চর্য হতে বাধ্য করে।

“পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। Lighthouse of Alexandria in bengali”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন