পাইওনিয়ার-১০ মিশন: মহাকাশ বা পৃথিবীর বাইরে যে অন্তহীন জগত সে বিষয়ে যারা একটু খোঁজখবর রাখেন তারা অবশ্যই জানবেন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত মহাকাশযানের কথা। এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ দূরে অবস্থিত মহাকাশযান দুটি হল ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২। কিন্তু এই দুটি মহাকাশযানের পর তৃতীয় স্থানে যে মহাকাশযানটি রয়েছে সেটির কথা যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, অনেকেই বলবেন নিউ হরাইজন মহাকাশযানের কথা। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন এই মহাকাশযানটি ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পৃথিবী থেকে ৪.১ বিলিয়ন মাইল (৬.৬ বিলিয়ন কিলোমিটার) দূরত্বে ছিল। বর্তমানে এটি কুইপার বেল্ট এর গভীরে প্রায় ৩৩ হাজার মাইল (৫৩ হাজার কিলোমিটার) প্রতি ঘন্টা গতিতে এগিয়ে চলেছে।
ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ এর পর যে মহাকাশযান পৃথিবীর থেকে সবচেয়ে দূরত্বে রয়েছে সেটি হল পায়োনিয়ার-১০ এবং এর পরে অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে রয়েছে পায়োনিয়ার-১১। কিভাবে এর সূচনা, কোথা থেকে এমন চিন্তা মাথায় এল নাসার সে বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
১৯৬০ এর দশকে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত নাসার রিসার্চ ইনস্টিটিউট জেট প্রপুলশন ল্যাবরেটরির বৈজ্ঞানিক গ্রে ফ্লান্দ্র (GRAY FLANDRO) গবেষণা করে জানান, প্রতি ১৭৬ বছরে আমাদের পৃথিবী ও সৌরমণ্ডলের প্রতিটি ছোট বড়ো গ্রহ সূর্যের একদিকে একসঙ্গে জড়ো হয়। এই ভৌগলিক রেখা বরাবর যদি কোন মহাকাশযান প্রেরণ করা হয় তবে খুব কম জ্বালানিতেই প্রতিটি গ্রহকেই অধ্যায়ন করা সম্ভব হবে। তিনি এই অধ্যায়নের প্রক্রিয়াকে গ্র্যান্ড টুর নাম দেন। গ্রহ গুলি একই রেখা বরাবর থাকার কারণে মহাকাশযানটিকে কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে এবং এর সাথেই বৈজ্ঞানিকরা গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের সাহায্য নিয়ে মহাকাশযানটি কে আরও দূরত্বে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। কল্পনামাফিক সেই সময় তারা মহাকাশে এমনই একটি মহাকাশযান পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। মহাকাশবিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তির মহাকাশযান তৈরি করেছিলেন, যেগুলি ছিল পায়োনিয়ার-১০ ও পায়োনিয়ার-১১। দুটি মহাকাশযানই ছিল পারমাণবিক শক্তি দ্বারা চালিত, স্থিতিশীল ও ছোট আকারের। বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরের গ্রহগুলো অধ্যায়নের জন্য।
আরও পড়ুন-ভয়েজার মিশন কি। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় মহাকাশ মিশন
এই মিশনের প্রথম মহাকাশযান অর্থাৎ পায়োনিয়ার-১০ কে ২ রা মার্চ ১৯৭২ সালে লঞ্চ করা হয়েছিল। মহাকাশ যানটি লঞ্চ করার পর এটি অনেকগুলি রেকর্ড গড়ে ফেলে।
পাইওনিয়ার-১০ এর রেকর্ডগুলি:
এটি ছিল প্রথম মহাকাশযান যেটি মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অবস্থিত গ্রহাণু বেল্ট ( asteroid belt) সফল ভাবে অতিক্রম করেছিল। এর সাথে এটি ছিল প্রথম মহাকাশযান, যেটি বৃহস্পতি ও তার চাঁদের খুব কাছ থেকে ছবি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আমাদের সৌরমণ্ডলের যে স্কেপ ভেলোসিটি রয়েছে, সেটি পার করে যাওয়া প্রথম মহাকাশযান ও ছিল এটিই। এরপর এটি সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী স্তর হিলিওস্ফেয়ার কে পার করে ইন্টারেস্টেলারে প্রবেশ করা তৃতীয় মহাকাশযান হতে চলেছে।
গতিপথ ও সময়কাল:
লঞ্চের কয়েকদিন পর অর্থাৎ ১৫ ই জুলাই ১৯৭২ সালে এটি গ্রহাণু বেল্ট (asteroid belt)এর কাছাকাছি পৌঁছায়। যেখানে এটি পার করাটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ যেকোন সময় অ্যাস্ট্রয়েড গুলির দ্বারা ধাক্কায় এটি যেকোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। তবে এটি সফলতার সাথে এই বেল্ট করে ফেলে এবং এই বেল্ট পার করা মানব নির্মিত প্রথম মহাকাশযান হিসেবে পরিচিত হয়। এটি বৃহস্পতির কাছাকাছি পৌঁছায় ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটি বৃহস্পতি থেকে শনি গ্রহ পর্যন্ত যাত্রা অতিক্রম করে। ১৯৮৩ সালের জুন মাসে এটি নেপচুনের অরবিট পার করে। বর্তমান সময়ে আমাদের পৃথিবী থেকে ৬৫ লাইটইয়ার দূরে অবস্থিত লাল তারা আল্ডেবারেন (ALDEBAREN) এর দিকে ছুটে চলেছে। এতদুর পৌঁছাতে পায়োনিয়ার-১০ এর সময় লেগে যাবে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর।
![১৯৭২ সালের পাইওনিয়ার-১০ মিশন। পৃথিবী থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ দূরে অবস্থানকারী মহাকাশযান 2 পাইওনিয়ার-১০ মিশন](https://extragyaan.com/wp-content/uploads/2021/07/rps20201117_233618.jpg)
পায়োনিয়ার-১০ এ বৈজ্ঞানিকরা একটি অ্যালমনিয়ামের প্লেট লাগান। যেটিতে আঁকা রয়েছে একটি পুরুষ ও একটি মহিলার ছবি, তার সঙ্গে সৌরমন্ডলে আমাদের অবস্থান অর্থাৎ পৃথিবীর অবস্থান। যদি ভবিষ্যতে এই মহাকাশযানটি কোন উন্নত সভ্যতার হাতে গিয়ে পড়ে তবে তারা যাতে এই অনন্ত ব্রহ্মান্ডে আমাদের খুঁজে পেতে পারেন সে কারণে এটি লাগানো হয়েছিল। এই মহাকাশযানের শেষ সিগন্যাল পাওয়া গেছিল ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে। এরপর থেকেই মহাকাশযানটি নিজের পথ বেছে নিয়ে এগিয়ে চলেছে নিজের মতই।
“১৯৭২ সালের পাইওনিয়ার-১০ মিশন। পৃথিবী থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ দূরে অবস্থানকারী মহাকাশযান”-এ 1-টি মন্তব্য