ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা সৃষ্টির ইতিহাস

ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা সৃষ্টির ইতিহাস: বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিজস্ব পতাকা বর্তমান; যা দেশের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকাও আমাদের দেশের প্রতীক, ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক।

ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা তৈরি হলো কীভাবে, কার মাথা তে এলো এই ধারণা; যে এতগুলো রাজ্য মিলে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে একটি পতাকা থাকা উচিত এ বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল।

একসময় ভারতের রাজ্যগুলির নিজস্ব পতাকা ছিল যে গুলির প্রত্যেকটি নকশা ছিল অন্যদের থেকে বেশ আলাদা। কিন্তু পুরো দেশের জন্য যে একটি পতাকা থাকা উচিত এমন ভাবনা আসে প্রথম ব্রিটিশদের মাথাতেই। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর যখন ভারত সরাসরি ব্রিটিশ শাসন এর আয়তায় আসে তখনই জাতীয় পতাকার আর্জি জানায় প্রশাসন। সে সময়ে যে পতাকাটি তৈরি হয় সেটি ছিল ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতই। ডানদিকের উপরের ইউনিয়ন জ্যাক ও নিচে মধ্যভাগে ছিল ইন্ডিয়ান স্টার।

আরও পড়ুন- মহাভারতের অশ্বত্থামা কে নিজের চোখে দেখার দাবি করছেন অনেকে

তবে প্রথম ভারতীয় পতাকার কথা বলতে গেলে প্রথমেই যার নাম আসবে তিনি হলেন শিরীষ চন্দ্র বসু। ১৮৮৩ সালে তিনি একটি পতাকার নকশা তৈরি করেন। যেটি ছিল সাদা রঙের এবং মাঝে লাল রঙের সূর্য আঁকা একটি পতাকা।

ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা সৃষ্টির ইতিহাস

ভারতীয় পতাকার সঙ্গে জাতীয় কথাটির ব্যবহার এই পতাকাটির থেকেই শুরু হয়। ১৯০৬ সালের ৭ ই আগস্ট প্রথমবারের জন্য জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় অনুশীলন সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের হাত ধরে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার পার্শিবাগান স্কোয়ারে প্রথমবারের জন্য জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক পতাকাই একে একে সকলের সামনে আসতে থাকে। কলকাতার ধর্মতলাএ গভর্নর হাউজের সামনে বিপ্লবীরা প্রথমবার তৈরি পতাকাটির মতোই আরেকটি পতাকা উত্তোলন করেন, যেটিতে ছিল তিনটি রং- উপরে লাল, মাঝে হলুদ, ও নিচে সবুজ। পতাকার লাল রঙের উপরে ৮টি কুসুম, হলুদ এর উপরে সংস্কৃত লেখা ‘ বন্দে মাতরম ‘, সবুজের উপর আঁকা সূর্য এবং অর্ধচন্দ্র। আবার মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের তৈরি পতাকাটি তে ছিল লাল, হলুদ ও নীল রঙ আর বাংলায় লেখা ‘ বন্দে মাতরম ‘।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিভিন্ন বড় বড় ব্যক্তিত্ব তাদের নিজস্ব মত পোষণ করেন পতাকা তৈরিতে। বালগঙ্গাধর তিলক বলেন গনেশএর কথা। অরবিন্দ ঘোষ ও বঙ্কিমচন্দ্র চেয়েছিলেন কালি, আবার অনেকেই গোমাতা কে চিহ্ন হিসেবে ব্যবহারের কথা বলেন পতাকায়। তবে সবক্ষেত্রেই পতাকা ছিল হিন্দুদের যার ফলে বাদ পরছিল মুসলমান অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি।

ভারতের জাতীয় পতাকা

১৯০৭ সালে ২২শে আগস্ট জার্মানিতে প্রথমবার ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মাদাম ভিকাজি রুস্তম কামা। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে তিনি যে পতাকা উত্তোলন করেছিলে তার নাম ছিল সপ্তর্ষি পতাকা। যার নকশা তৈরি করেন মাদাম কামা, বীর সাভারকার ও শায়ামজি কৃষ্ণ বর্মা। এরপর ১৯০৯ সালে ভগ্নি নিবেদিতা একটি পতাকা তৈরি করেন যা ছিল লাল রঙের যার মাঝে আঁকা বজ্রের দুই পাশে লেখা বন্দেমাতরম।

১৯১৬ সালে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া ৩০টি নতুন নকশা দিয়ে একটি পুস্তিকা তৈরি করেন। যা অনেক প্রশংসিত হলেও তেমন কোনো সুরাহা হয় নি। ১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী বলেন জাতীয় পতাকার কোন এক জাতীয় চরিত্র কে চিহ্নিত করার কথা; এবং এ ব্যাপারে তিনি তার পছন্দের চরকা বেছে নেন। সেই মতো পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া একটি নকশা তৈরি করেন যেটি উপরে লাল নিচে সবুজ এবং তার মাঝখানে ছিল চরকাটি।

পরের বছর কংগ্রেসের মিটিংয়ে সিটিকে সামান্য পাল্টে দেওয়া হয়। নতুন তৈরি পতাকাটি নিচে ছিল লাল, মাঝে সবুজ ও উপরে সাদা রং এবং মাঝে নীল রংয়ের চরকা। পতাকার লাল রং ছিল বৃহত্তর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতীক; সবুজ রঙ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতীক এবং উপরে সাদা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতীক ছিল। ১৯২৩ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই পতাকা ব্যবহার করা হতো ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা হিসেবে। ১৯৩১ সালের ২রা এপ্রিল এই পতাকা কে নিয়ে ওঠে তীব্র আপত্তি। এরপর ৬ ই আগস্ট এর রং পরিবর্তন করা হয়।

পরিবর্তিত এই নতুন পতাকাটির রং ছিল উপরে গেরুয়া মাঝে সাদা আর নিচে সবুজ। এবং সাদা রং এর মাঝখানে ছিল নীল রঙের চরকা। যেখানে গেরুয়া রং ছিল ত্যাগের প্রতীক; সাদা রঙটি ছিল সত্য ও শান্তির প্রতীক; এবং সবুজ ছিল বিশ্বাস, নির্ভীকতা ও কর্ম শক্তির প্রতীক এবং চরকাটি অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতীক।

স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাস আগেই গণপরিষদ তৈরি হয়। রাজেন্দ্র প্রসাদ এর নেতৃত্বে গণপরিষদে এক বিশেষ কমিটি গঠিত হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, কে.এ মুন্সী ও বি.আর আম্বেদকর। ১৪ই জুলাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অশোক চক্রের চক্রটিকে পতাকার মাঝে নীল রঙের ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এরপরে এলো সেই ঐতিহাসিক দিন; ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন ভারতের আকাশের সেদিন প্রথমবারের জন্য উড়ল আমাদের জাতীয় পতাকা। ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা বিবর্তনে পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া নাম বারবার উঠে আসলেও অশোক চক্রের তৈরি শেষ নকশা টি কার তৈরি সে বিষয়ে আজও রয়েছে অনেক বিতর্ক।

“ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা সৃষ্টির ইতিহাস”-এ 1-টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন