আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (International Space Station)
আজ থেকে ২০বছর আগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রথমবার মানুষ পদার্পণ করেছিল। ২য় নভেম্বর ২০২০ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানবজাতির ২০বছর সম্পন্ন হয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গত ২০ বছরের ইতিহাস।
মানবজাতির সৃষ্টির পর থেকেই অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার কৌতূহল মানুষকে আজ এত উন্নত করেছে। বর্তমান যুগের কম্পিউটার, মোবাইল থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ও মহাকাশে মানুষের সফলতা, মানুষ তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়েছে।
উনিশ শতকের শুরু থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে মহাকাশে মানুষ কিভাবে নিজেদের বাসস্থান গড়ে তুলবে। আর সেই চিন্তা ভাবনা থেকেই রাশিয়া ১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম একটি মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘সেলুট-১’। এরপর আমেরিকা ১৯৭৩ সালে তাদের একটি মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর কক্ষপথে পেরণ করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘স্কাইল্যাব’। কিন্তু এই দুটি ছিল তাদের নিজেদের দেশের মহাকাশ স্টেশন যা সেই সময় আমেরিকা ও রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াইয়ের ফল বলে গণ্যকরা হয়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নির্মাণ
এর পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা একটি মিশন শুরু করে যার নাম ছিল ‘ফ্রিডম’ কিন্তু সেই সময় আমেরিকার তৎকালীন সরকার এই মিশনে অর্থ দিতে রাজি না হওয়ায় সেই সময় মিশনটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নাসা ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থা গুলির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং মিশনটি পুনরায় শুরু করে। মিশনটির নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। মোট ১৫টি দেশের অর্থ বিনিয়োগের পর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সর্বপ্রথম অংশটি পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয় ২০ই নভেম্বর ১৯৯৮, যার নাম দেওয়া হয় ‘জারিয়া’। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অংশকে মহাকাশ স্টেশনের সাথে যুক্ত করে তৈরি হয় ‘আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন’। যেখানে ২০০০ সালে প্রথমবার মানুষের একটি দলকে পাঠানো হয়। তিনজন সদস্যের এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিল শেফার্ড, রাশিয়ার সেগেই ক্রিকালেগ ও ইউরি গিডজেনকো। মধ্য এশিয়ার কাজাকিস্তান থেকে মহাকাশ যানটি প্রেরণ করা হয় মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে, এর দু-দিন পর তিনজন সদস্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছে যায়।
এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি প্রধানত আমেরিকার nasa, জাপানের jaxa, কানাডার csa, রাশিয়ার roscosmos, ইউরোপের esa দ্বারা পরিচালিত হয়েআসছে। মহাকাশে স্টেশন নির্মাণ করতে মোট ১৪ বছর সময় লেগেছে। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার এর মিশন লঞ্চ করার পর ২০১১ সালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এর পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গবেষণার জন্য মহাকাশ স্টেশন আধুনিকরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি আমেরিকান ডলার। ভারতীয় টাকায় যা আপনি নিচের ছবিতে দেখতে পাবেন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে খরচ হয়েছিল



আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রাশিয়ার আলাদা একটি বিভাগ আছে, সেটা শুধুমাত্র রাশিয়া ব্যবহার করে। অপর ভাগে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, কানাডার অংশ রয়েছে। প্রত্যেকটি ‘মডিউল’ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিজেদের দেশেই তৈরি। মহাকাশযানের মাধ্যমে প্রত্যেকটি দেশ নিজেদের মডিউল কে লঞ্চ করে পৃথিবীর কক্ষপথে একত্রিত করেছে।
আরো পড়ুন- চাঁদে জলের খোঁজ পেলো নাসা
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বিবরণ
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মোট আয়তন প্রায় একটি বড় ফুটবল মাঠের সমান। মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে সময় ১ঘন্টা ৩০মিনিট, ফলে স্টেশনটি প্রতিদিন পৃথিবীকে মোট ১৬বার প্রদক্ষিন করে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় মহাকাশ স্টেশনের গতি থাকে প্রায় ২৮,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। আমাদের পৃথিবীর ভূভাগ থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উচ্চতা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। এর মোট ওজন প্রায় ৪২০,০০০ কিলোগ্রাম।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে মোট ৬জন মহাকাশচারী একবারে থাকতে পারে। প্রতি ৬মাস অন্তর মহাকাশচারীদের পরিবর্তন করা হয়। মহাকাশচারীদের থাকবার জন্য স্টেশনটিতে আলাদা জায়গা রয়েছে যেখানে রান্নাঘর, শরীর স্বাস্থ্যের জন্য জিম, শোবার ঘর রয়েছে। জায়গাগুলি অত্যন্ত ছোট হলেও এখানে মহাকাশে ব্যবহৃত বিশেষ কাপড় ছাড়াই মহাকাশচারীরা থাকতে পারে, কারণ জায়গাটা সম্পূর্ণ চাপ যুক্ত অবস্থায় তৈরি। এই স্থানটি সম্পূর্ণ মহাকাশ স্টেশনের মাঝে অবস্থিত, মহাকাশ স্টেশনটি সম্পূর্ণভাবে সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। মহাকাশ স্টেশনের ছবিতে যে ডানার মতো লম্বা হাত গুলি দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি সম্পূর্ণ ‘সোলার প্যানেলে‘ পরিপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সোলার প্যানেল



সূর্য থেকে সৌর শক্তি সঞ্চয়ের ফলে মহাকাশ স্টেশনে গরমের সৃষ্টি হয়, আর সেই কারণে স্টেশনের মধ্যে রেডিয়েটর প্যানেলের সংযুক্তিকরণ করা হয়েছে। যেগুলো স্টেশনের অতিরিক্ত গরমকে বাইরে বের করে দেয়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নির্মাণের মূল কারণ হলো গবেষণা, যে গবেষণা গুলি পৃথিবীতে সম্ভব হয় না। কারণ পৃথিবীতে গবেষণা করার সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, জলবায়ু ও প্রকৃতি গবেষণার ওপর প্রভাব ফেলে, আর সেই কারণেই যে গবেষণাগুলো পৃথিবীতে সম্ভব নয় সেগুলি স্পেস স্টেশনে সম্পন্ন করা হয়। মহাকাশ স্টেশনে বিশেষত চাঁদ ও মঙ্গলকে নিয়ে গবেষণা করা হয়, যাতে চাঁদে গিয়ে মহাকাশচারীরা বাসস্থান নির্মাণ করতে পারে এবং এই মহাকাশ স্টেশনের মতো একটি গবেষণাগার তৈরি করতে পারে। বিশেষত এই সব নিয়েই পরীক্ষা চালানো হয় মহাকাশ স্টেশনে।
এই মহাকাশ স্টেশনে প্রত্যেকটি দেশের পৃথক গবেষণাগার রয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের মহাকাশচারীদের সেখানে নিজেদের গবেষণা করে আসছে আমেরিকার গবেষণাগারের নাম ডেসটিনি(destiny), জাপানের kibo(কিবো), রাশিয়ার পইস্ক(poisk), ইউরোপের গবেষণাগারটি আমেরিকার মধ্যে সংযুক্ত রয়েছে। স্টেশনের এই সবগুলি বিভাগ একটি শক্ত কাঠামোয় সাথে যুক্ত, যাকে বলা হয় ‘ট্রস'(truss)। এই ট্রসের উপর নির্ভর করেই স্টেশনের সমস্ত অংশগুলি থাকে।
আরো পড়ুন- ভয়েজার মিশন কি। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় মহাকাশ মিশন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে বাইরের অংশে যদি কোনরকম প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা কোন সমস্যা হয় সেটারও উপায় আছে। মহাকাশ স্টেশনের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় রোবোটিক আর্ম রয়েছে যেগুলো মহাকাশচারীরা ভেতর থেকে পরিচালনা করতে পারে। এই হাত গুলিকে বলা হয় ‘কানাডার্ম’, কারণ কানাডা এই হাত গুলোকে তৈরি করেছে। কানাডা আরও একটি রোবট তৈরি করেছে যার নাম ‘ডেক্সটর‘, এটি রোবটিক আর্মের একদম মাথায় অবস্থিত, যা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজগুলো সম্পন্ন করে। এছাড়াও মহাকাশচারীদের যদি কোন সময় বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় সেটারও ব্যবস্থা আছে, বাইরে যাওয়ার জন্য তাদের বিশেষ ধরনের ‘স্পেস সুট‘ ব্যবহার করে। বাইরের দৃশ্য বা যদি মহাকাশচারীদের পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছা হয় তাহলে তার জন্য আলাদা একটি কক্ষ আছে যার নাম ‘কিউপোলা‘ এই কক্ষে মোট ৭টি জানালা আছে।



আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন মানব ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব সৃষ্টি পৃথিবীর বাইরে থাকা একটি কাঠামোতে মানুষ গত ২০বছর ধরে বস-বাস করে এসেছে।
[…] […]